ফাহমিদা হক
২০১৭ সালের ২৫ আগষ্ট ছিল রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিজয় উল্লাসের দিন, অসহায় রোহিঙ্গারা এই দিন থেকে ঘর বাড়ি ছেড়ে দলে দলে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে থাকে। সাম্প্রতিক কালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শরণার্থী হয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এবার মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ষড়যন্ত্র করে সমূলে উচ্ছেদ করতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বমানবতার কাছে সবচেয়ে নিষ্ঠুর গণহত্যা, মানবতার চরম লঙ্ঘন, জাতিগত নিধনের চরম লজ্জার, এক কলন্কজনক অধ্যায় রচিত করেছে মিয়ানমার। শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সান সুচির সেনাবাহিনী ওই দিনটিকে তাদের শত্রু নিশ্চিহ্ন করার পরিপূর্ণ সফলতম দিনের শুরু হিসেবে চিহ্নিত করলেও বিশ্ববাসীর কাছে এটা শুধুই লজ্জার।
একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বর্বর হত্যাযজ্ঞের নামে রোহিঙ্গা নিধনের মাধ্যমে যে ইতিহাসের কালো অধ্যায়ের সূচনা করেছে মিয়ানমার, তার প্রায়শ্চিত্ত এখন বাংলাদেশকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এক বছরে আরো ৬০ হাজার নতুন অনাকাংখিত মানুষের চাপ, এ যেন ঘাড়ের উপর বিষ ফোঁড়া। ৬০ হাজার এই নতুন রোহিঙ্গার জন্ম হয়েছে বাংলাদেশে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে প্রসংশা কুড়িয়েছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বাংলাদেশ সফর করেছেন এবং সবাই বলেছেন, রোহিঙ্গাদের দ্রুত মিয়ানমারে ফেরত নিতে হবে। আন্তর্জাতিক মহলের ব্যাপক তৎপরতা, সহানুভূতি শুরু থেকেই ছিল, আছে। মিয়ানমার যাচাই-বাছাই করে ফেরত নেয়ার আশ্বাস দিয়েছে কিন্তু আদতে বছর পেরিয়ে গেলেও ফিরিয়ে নেয়া শুরুই হচ্ছে না।
যদিও বাংলাদেশ মনে করেছিল দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে এই সংকটের সমাধান সম্ভব কিন্তু মিয়ানমার ইতিমধ্যেই রোহিঙ্গা বিতাড়ন নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) দেয়া চিঠি গ্রহন না করে তাদের ঔদ্ধত্য আচরণেরই প্রকাশ করেছে। মিয়ানমার যে পদ্ধতিতে যাচ্ছে এতে করে বলাই যায় রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে দ্বিপাক্ষিক কোনো চুক্তি বা আলোচনাতে কাজ হবে না। সবাই জানি, এটা বাংলাদেশের একার কাজ নয়, তাই আন্তর্জাতিক তৎপরতার মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করেই রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ, নিজেদের মাটির অধিকার ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করতে হবে।
এদেশে প্রাণ ভয়ে পালিয়ে আসা মানুষদের জন্য যারা মানবিক সহায়তার হাত বাড়িয়েছিলেন, আজ ১০ লাখের বেশী রোহিঙ্গাদের চাপে তাদের নিজেদের জীবন ও জীবিকাই হুমকির মুখে। মানবিক কারণে যে পরিবারটি নিজের উঠানেই কোন রোহিঙ্গা পরিবারকেও আশ্রয় দিয়েছিলেন, আজ বছর ঘুরতেই সেই রোহিঙ্গা পরিবারের নানারকম আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন সেই গেরস্স্ত। নিজেরাই কোনঠাসা হয়ে পরেছেন আশ্রিতদের কাছে। নিজের দেশে নিজেকেই আশ্রিত মনে হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে বহুবিধ সমস্যা সৃষ্টির অন্যতম কারণ, অত্যাধিক মানুষের চাপ, তাছাড়া এই রোহিঙ্গারা মূলত জাতিগতভাবে নিরক্ষর, সবার্থে অনগ্রসর ও কুসংকারাচ্ছন্ন।
রোহিঙ্গাদের আগমন এদেশে নতুন নয় কিন্তু গত বছর আগষ্ট মাসে, যে ভাবে রোহিঙ্গারা নাফ নদী দিয়ে, পায়ে হেঁটে দলে দলে এদেশে এসেছে তা ইতিহাসে নজির বিহীন। জেলেদের মাছ ধরা নৌকায় করে রোহিঙ্গাদের পারাপার বন্ধে এখানে জেলেদের মাছ ধরাই বন্ধ অন্তত: দশ মাস ধরে। এসব জেলেদের পরিবারের একমাত্র কাজ বন্ধ হওয়ায় ওরা পথে বসার উপক্রম। রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য ভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্র থাকলেও এসব জেলে পরিবার সম্পূর্ণ অসহায়।
কক্সবাজার, উখিয়া ও টেকনাফ এলাকাতে মূলত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় মিলেছে। সরকারি হিসেব মতে এই এলাকাতে ৩০ টি রেজিষ্টার্ড ক্যাম্প রয়েছে। কিন্তু উখিয়া ও টেকনাফের মুল সড়কগুলো ধরে গাড়ি চালিয়ে গেলে দেখা যাবে বন বিভাগের জমি, সরকারি খাস জমি ও সাধারণ মানুষজনের জায়গায় ও পাহাড়ের গায়ে রোহিঙ্গাদের আরো অসংখ্য খুপড়ি ঘর। বহু পাহাড়ে এখন কোন গাছ নেই, সেখানে ছোট ছোট কুঁড়ে ঘরের চালই শুধু দেখা যায়। বিশাল বনভূমি উজার হয়ে গেছে, খাবার পানির ব্যাপক সংকট দেখা দিচ্ছে। আর আগে যেসব রোহিঙ্গারা এসেছিলেন এরা এরই মধ্যে সাধারণ জনগণের সাথে মিলেমিশে গেছেন।
দলে দলে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকে স্হানীয় কৃষকের আবাদি জমিতে আশ্রয় নিয়ে এখন স্হায়ী বসতি স্হাপন করাতে এই এলাকার অনেক জমির চাষ বন্ধ হওয়ায় স্হানীয় কৃষক ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এসব ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের মৌসুমের পর মৌসুম বিনা ফসলে পার করতে হচ্ছে এতে সমস্যা দিনকে দিন বাড়ছে বরং কমছে না। একদিকে ফসল বন্ধ অন্যদিকে গবাদি পশু চুরি জনজীবনে নানাবিধ সমস্যার জন্ম দিচ্ছে, জনসংখ্যার চাপে পিষ্ঠ এই জনপদে না আছে স্হানীয়দের স্বস্হি না আছে রোহিঙ্গাদের নিশ্চিত ফিরে যাওয়ার স্হায়ী কোনো পরিকল্পনা।
কক্সবাজারের স্হানীয় লোকজনের ভাষ্য মতে, মানবিক কারণে এক সময় ঠাঁই পাওয়া রোহিঙ্গারা দিন দিন স্হানীয়দের সহানুভূতি হারাচ্ছে। কারণ অস্হায়ী ভাবে আশ্রিতরা এখন সব কিছুতে জেঁকে বসেছে, স্হানীয়দের তুলনায় রোহিঙ্গাদের জনসংখ্যা এখানে দ্বিগুন, ফলে সবকিছুতে এরা এমন ভাবে স্বাভাবিক জীবন যাপনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে চলছে যে আশ্রয়দাতারা নানা ভাবেই এখন কোনঠাসা হয়ে পরছে। দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি, চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের সংকট, শ্রমের মূল্য কমে যাওয়া, স্বল্প স্হানে অধিক জনসংখ্যার চাপে এই এলাকার জণজীবনে স্বাস্হ্য শিক্ষাসহ সবক্ষেত্রে নেমে এসেছে চরম বিপর্যয়। এই বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে হলে রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে ফেরানোর ব্যবস্হা করতেই হবে।
প্রত্যাবাসন আদৌ হবে কি না বা হলে কবে হবে তা নিয়ে অবিশ্বাস আরো জোরালো হচ্ছে রোহিঙ্গাদের মধ্যেই। কারণ বাংলাদেশে যে রোহিঙ্গারা আছেন, তাদের ফেরত নিতে কয়েক দফা বৈঠকের পর এ বছরের শুরুতে মিয়ানমারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। যেখানে তালিকা অনুযায়ী ধাপে ধাপে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে রাজী হয়েছিল মিয়ানমার। প্রথম দফায় একটি তালিকাও হস্তান্তর করা হয় কিন্তু আজ অব্দি একজনকেও ফেরত নেয়নি মিয়ানমার । মিয়ানমারে সাজানো গোছানো সংসার ফেলে আসা মানুষগুলো নিজের মাটিতে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন কোনদিন সফল হবে নাকি শরণার্থী জীবন আরো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে তাই এখন ভাবনার বিষয়।
এতদিন রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের সম্পৃক্ততা চেয়ে এসেছিলেন, কিন্তু গত জুনে জাতিসংঘের দুটি সংস্হার সংঙ্গে মিয়ানমারের একটি চুক্তি সাক্ষরের পর তা নিয়ে রোহিঙ্গারা নিজেরাই সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। এর কারণ- “আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস” -এর সভাপতি মোহিব উল্লাহ বলেছেন, জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানা যায়নি, চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের স্বার্থ রক্ষা সংশ্লিষ্ট সব দাবি অন্তর্ভূক্ত আছে কি না। ওদের মিষ্টি কথা- চুক্তিতে ভালো কিছু আছে – কিন্তু রোহিঙ্গারা মনে করে সুচির বর্বর বাহিনীর কাছে এমন মিষ্টি কথায় চিড়া ভিজবার নয়; তাই চুক্তিতে এসব রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব, শিক্ষা বা মুক্তভাবে চলাফেরা করার মতো বিষয়গুলোকে সুস্পষ্ট ভাবে উল্লেখই করা হয়নি। যদিও জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্হা ইউএনএইচসিআর বলছে মিয়ানমারের সংঙ্গে তাদের চুক্তির ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিরাপদ টেকসই হবে।
জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের হিসাব অনুযায়ী মিয়ানমারে জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। কেবল ২০১৭ সালের আগষ্ট থেকে এ পর্যন্ত ৭ লাখ ৭ হাজার রোহিঙ্গা এদেশে এসেছে। আর এই রোহিঙ্গাদের সঙ্গে এদেশে আসার পর এক বছরে জন্ম নিয়েছে বা নতুন মুখ যুক্ত হয়েছে আরো ৬০ হাজার। এভাবে এই শরণার্থী সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই, যা কেবল আমাদের জন্যে আরো ভয়ংকর চ্যালেন্জ হয়ে সামনে আসবে।
এদিকে সর্বশেষ খবর বলছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দমনপীড়নের মুখে বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়া শরণার্থী সংকটের সূচনা হওয়ার পর বছর পেরিয়ে গেলেও রোহিঙ্গাদের পালিয়ে বাংলাদেশে আসা বন্ধ হয়নি। দুই মাস আগেও হামিদা বেগম নামের রোহিঙ্গা নারী তার স্বামী আর দুই শিশু সন্তান নিয়ে কক্সবাজারের বালুখালী ক্যাম্পে আশ্রয় নেন।এমন আরো নতুন মানুষ পরিবার নিয়ে যুক্ত হওয়ার খবর রয়েছেই।
বিপুলসংখক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ ভুল করেনি, বরং মানবিকতা আর ঔদার্যের এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে বিশ্ব মানচিত্রে। কিন্তু দিন, মাস, বছর, বছরের পর বছর এ ভার বইবার সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে কিনা সেটিও দেখতে হবে। নানাভাবে এই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংকট বাড়িয়ে তুলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন সহ পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশের পাশে থাকলেও পাশে নেই কাছের মিত্র ভারত, রাশিয়া, চীন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর জাতিসংঘের সাধারন অধিবেশনে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে পাঁচটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যা সর্বমহলের প্রশংসা কুড়িয়েছিলো। নিরাপত্তা পরিষদও কয়েকদফা বৈঠক করেছে। আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারকে কাঠগড়ায় দাড় করানোর কথা হচ্ছে। কিন্তু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ন্যূনতম অগ্রগতি নেই। তারপরও আশায় বুক বেঁধে সবার দৃষ্টি এখন এই সেপ্টেম্বরের জাতিসংঘ সাধারন অধিবেশনের দিকে।